ধীর কণ্ঠে আয়ান বলল, ‘প্রথম শব্দ দু'টির চেয়ে আরো মারাত্মক একটি শব্দ আছে। যেটাকে ধর্ষণের খুব তোড়জোড় চলছে। মিডিয়া আর পত্রিকাগুলো যেন উঠেপড়ে লেগেছে।’
‘কী সেটা?’
‘পর্দা।’
‘পর্দা! এটা তো ইসলামের স্পষ্ট বিধান। এটাকে আবার কী করছে?’
‘শুনবি? ওদের হিংস্র লালসা এতটাই প্রকট যে, হিতাহিত জ্ঞান পর্যন্ত হারাতে বসেছে। খুব ভয় হয় আমার, কখন যেন আসমান থেকে রবের গজব ঠিক ওদের মাথার ওপর এসে পড়ে।’
‘কী করল বল তো!’
‘আগে পর্দার সংজ্ঞাটা শোন। 'পর্দা' শব্দের অর্থ- আবৃত, ঢাকা, আড়াল করে রাখা/থাকা ইত্যাদি। এক কথায়, নারীপুরুষ উভয়কে তাঁর গায়রে মাহরাম থেকে নিজেকে (নিজের সতর) আড়ালে রাখাকে পর্দা বলে। অর্থাৎ নিজের সৌন্দর্যের সবটুকু (বিশেষ কিছু অবস্থা ও জরুরত ছাড়া নারীর চেহারা ও কণ্ঠও পর্দার হুকুমের মধ্যে) আড়ালে রেখে যথাযথ হেফাজতের নাম পর্দা। আর এই পর্দা নারীপুরুষ উভয়ের জন্যই বাধ্যতামূলক। সামাজিক, নৈতিক ও চারিত্রিক অবক্ষয় রোধে পর্দার কোন বিকল্প নেই।
তাই ইসলাম পর্দাকে ফরজ করেছে। এর যথাযথ বাস্তবায়ন সামাজিক, নৈতিক ও চারিত্রিক অবক্ষয় এবং ধর্ষণ রোধের অব্যর্থ হাতিয়ার। সেই সাথে ইসলামের বিধান অনুযায়ী যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করাও অপরিহার্য।
কিন্তু কতক কথিত শিক্ষিতদের কলমীয় ও মগজীয় ধর্ষণের স্বীকার এই 'পর্দা' শব্দটি। কলম ও মগজের দুষ্টু ব্যবহারের আগ্রাসী আক্রমণে 'পর্দা' শব্দটিকে বিভিন্ন বই, পত্রিকা, টকশো, মিডিয়া ও অনলাইনে লেখনী ও মৌখিক কারচুপির দ্বারা মগজধোলাইয়ের মাধ্যমে ক্রমাগত ধর্ষণ করে করে একটি 'প্রথা' জ্ঞান করা ও নারীর আর্থসামাজিক ‘উন্নয়নের অন্তরায়’ হিসেবে দায়ী করার অপচেষ্টা চলছে।
বিক্ষিপ্তভাবে অসংখ্য বই-পত্রিকায় তো আছেই, এছাড়াও সেদিন দেখলাম দেশের স্নাতক শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক 'Political Science'- 6th part (রাষ্ট্রবিজ্ঞান বইয়ের ৬ষ্ঠ পত্র 'নারী ও রাজনীতি' অধ্যায়)-এ স্পষ্ট ভাবে এই অপচেষ্টা করা হয়ে হয়েছে। আরো বিভিন্ন শ্রেণীর বিভিন্ন পাঠ্যবইয়ের ভাঁজে ভাঁজে প্রথিত করা হয়েছে এই 'স্লো পয়জন' বা নিরব ঘাতক অপব্যাখ্যা।
এসকল বইয়ে 'পর্দা' শব্দটিকে বারংবার 'পর্দাপ্রথা' বলে বলে ধর্ষণের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর করা হয়েছে। সূক্ষ্ম ভাবে দেশের কলেজ-ভার্সিটিগুলোর লক্ষলক্ষ ছাত্রছাত্রীদেরকে ইসলামের ফরজ বিধান 'পর্দা'-কে নিছক একটি 'প্রথা' হিসেবে গিলানোর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ এসকল মুসলিম ছাত্রছাত্রীরা সূক্ষ্ম এই 'শব্দ ধর্ষণ'-এর মারপ্যাঁচে ফেঁসে গিয়ে পরবর্তিতে পর্দার বিরুদ্ধে মুখ খুলছে, পর্দাকে উন্নতির অন্তরায় মনে করছে এবং উন্নয়নের নিমিত্তে পর্দাকে 'পর্দাপ্রথা' জ্ঞান করে এর বিলুপ্তি কামনায় উদগ্রীব হয়ে পড়ছে।’
আয়ান থামল। অপুর্ব’র কপালে চিন্তার গভীর ভাঁজ! আয়ান লক্ষ করে বলল, ‘শোন, খুব মন দিয়ে শোন। আমাদের খুব করে মনে রাখা দরকার, এবং সুযোগ মত তাদের ও নারীদের বুঝানো দরকার যে- পর্দা রক্ষা করে নারীকে যে কোনো বৈধ কাজের অনুমতি ইসলাম দিয়েছে। ঘরে-বাইরে যে কোনো বৈধ কাজে সে অবদান রাখতে পারে। নারীকে গৃহবন্দি করা নয়; নানাবিধ অবক্ষয় ও ধর্ষণ রোধ এবং নারীর যথাযথ হেফাজতই পর্দার মূল উদ্দেশ্য। কাজেই 'পর্দা' নারীর অগ্রগতির অন্তরায় নয়; সার্বিক উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ ও অগ্রযাত্রার নিয়ামক।
এই কথাটি না জানা বা না বুঝার কারণে অনেকেই পর্দাকে উন্নতি ও অগ্রগতির অন্তরায় মনে করে এবং পর্দার বিধানকে 'প্রথা' জ্ঞান করে নিজেদের ঈমানকে খুয়িয়ে বসে।’
দীর্ঘশ্বাস অপূর্ব’'র। হাতে চিমটি কেটে আয়ান বলল, ‘ঐ ব্যাটা! বুড়ো মানুষের মত এমন ন্যুব্জ হয়ে দীর্ঘশ্বাস নিলে চলবে? দেশ ও জাতী নিয়ে তো আমাদেরই ভাবতে হবে। কেবল গদবাধা পড়াশোনা আর বিনোদন-আড্ডাবাজীতে পড়ে থাকলে চলবে? একজন এডুকেটেড পার্সন ও সচেতন নাগরিক হিসেবে কিছু নৈতিক দায়িত্ব আছে। একজন মুসলিম হিসেবে কিছু ঈমানী দায়িত্ব আছে। এসব থেকে গা বাচিয়ে চললে নিজের বিবেকের কাছে আজীবন অপরাধী হয়ে থাকতে হবে। আর ময়দানে হাশরে রব্বে কারীমের কাছেও অপরাধী হিসেবে দাঁড়াতে হবে।’
‘সত্যিই রে আয়ান। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। কী করা উচিৎ ছিল আমাদের, আর কী করছি আমরা! গদবাধা সিলেবাস নিয়ে বুদ হয়ে আছি। পড়াশোনা শেষ হলেই জব নিয়ে বুদ হয়ে থাকব। সমাজ, দেশ ও আখেরাত নিয়ে ভাবার ফুরসৎ কোথায়!’
'একটু ভাবা দরকার। স্থির চিন্তাশক্তি ও কর্মশক্তিকে বেগবান করা দরকার।’
‘খুব চিন্তায় ফেলে দিলি আয়ান।’
অপূর্ব'র কাঁধে হাত রেখে আয়ান বলল, ‘শোন,এখানে আরও একটি বিষয় বুঝে নেওয়া দরকার যে- 'প্রথা' এক জিনিস আর 'বিধান' এক জিনিস।
'প্রথা' হলো- সামাজিক বহুল প্রচলিত কোন বিষয় বা কাজ। যেটা কেবল সামাজিকভাবেই মূল্যায়িত। এটা হতে পারে কোন কুপ্রথা বা সুপ্রথা। আর এটা তখন পালন করা বা না করা কেবল সামাজিকতা বৈ কি!
'বিধান' হলো- অকাট্য নির্দেশ বা আইন। যেটা মান্য করা বাধ্যতামূলক। হেলায় অমান্যকারী শাস্তির উপযুক্ত। আর কটাক্ষপাত ও অস্বীকারকারী আরও কঠোর থেকে কঠোরতর শাস্তির উপযুক্ত। সেই সাথে ইসলাম থেকেও সে খারিজ (ডিলেট) হয়ে যাবে। সে আর মুসলিমই থাকবে না।
আর 'পর্দা' হলো ইসলামের তেমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। এটাকে 'প্রথা' জ্ঞান করা নিজেকে মুসলিম দাবি করার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অনেকে হয়তো এতটা গভীরভাবে ভাবেনি বিষয়টি। কিন্তু ভয়ের কথা হলো, অজ্ঞাতেই অনেক কথা, লেখনী ও ভাবনা আমাদের মুসলমানিত্বকে পিসে ফেলে।
'পর্দা' শব্দটির এই আগ্রাসী ধর্ষণের সবচেয়ে মারাত্মক ফলাফল হলো- আমাদের বর্তমান জেনারেশনের পর্দার বিরুদ্ধে আড়চোখা অবস্থান।
এভাবে চলতে থাকলে আগামীপ্রজন্মের মাঝে রবের এই অকাট্য বিধান 'পর্দা' নিছক 'প্রথা' হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হবে। আল্লাহর পানাহ…
কে জানে! ‘শব্দ ধর্ষণ’ নামক ওদের এই আগ্রাসনের শেষ কোথায়!’ আয়ান থামল।