দ্য জেরুজালেম সিক্রেট: বিষয়বস্তু, ঘটনাপ্রবাহ ও ইসরায়েলে নিষিদ্ধকরণ নিয়ে কিছু কথা ইসরায়েলে একটি উপন্যাস নিষিদ্ধ করার কী অর্থ হতে পারে? এটা কি সম্পূর্ণরূপে ইহুদিবিরোধী? নাকি সংবেদনশীল উপায়ে ইহুদি মতাদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করে? নাকি ফ্যান্টাসি উপন্যাস হিসেবে পরিগণিত হওযার জন্যে তাতে যথেষ্ট পরিমাণে মিথ্যাচার করা হয়? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—বর্তমানে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের যুগে এ রকম একটি বই নিষিদ্ধ করার কী যথার্থতা থাকবে, যেখানে তার ই-বুক কপি পর্যন্ত এভেইলেবল! আমরা ভিন্ন কোনো উপন্যাস গ্রন্থের কথা বলছি না, কথা বলছি বক্ষমান গ্রন্থ “দ্য জেরুজালেম সিক্রেট” নিয়ে। মূল গ্রন্থ ইংরেজিতে, দীর্ঘ চারশো পৃষ্ঠার। গ্রন্থের শেষে লেখক তেরো পৃষ্ঠার একটি নির্ঘন্ট এনেছেন, যেখানে উপন্যাসে উল্লিখিত বিভিন্ন ইহুদিদের পরিভাষা, বড় বড় ব্যাক্তিবর্গ ও স্থানের তালিকা আনা হয়েছে, সাথে কিঞ্চিত্ পরিসরে পরিচিতও দেয়া হয়েছে। এতসবের পর এ উপন্যাসকে নিছক “কাল্পনিক” বলে ইসরায়েলের মতো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের হেতু কী থাকতে পারে? এর কারণ কী স্বয়ং লেখক পল সসম্যান ও তার ইহুদি-বিদ্বেষ যে, তার মতাদর্শের সংক্রমণ থেকে সবাইকে রক্ষা করার জন্য এ নিষিদ্ধকরণ? কিন্তু লেখকের প্রসিদ্ধি বিবেচনায় এ একেবারেই অবাঞ্ছনীয়। উইকিপিডিয়াতে তাকে নিয়ে খুব সামান্য তথ্য আছে। তাছাড়া তিনি উপন্যাসের চরিত্রগুলো যেভাবে সাজিয়েছেন, সেখানে তার পরম মধ্যপন্থী ভাবটিই উঠে আসবে। সেখানে তিনি ইহুদিদের প্রতি জাতিগত বিদ্বেষকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। এছাড়া নাত্সিবাদ নিয়ে রয়েছে তীর্যক আলোচনা। এসবের পরও বইটি নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ কী? না, এসবের কোনোটিই বইটি নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ নয়। কারণ খুঁজতে হলে আমরা বইয়ের শিরোনাম লক্ষ্য করি—টেম্পল রহস্য। এ রহস্যকে ঘিরে রয়েছে মেনোরা—যা ইহুদি ধর্মের সর্বোচ্চ নিদর্শন। একটু ব্যাখ্যা করেই বলি, ৭০ খ্রিষ্টাব্দের আক্রমণে ইহুদিরা তাদের মেনোরা হারিয়ে ফেলে। এরপর থেকে তারা এখনো এই পবিত্র নিদর্শন অনুসন্ধান করে যাচ্ছে। ইহুদিদের বিশ্বাস, এ মেনোরা প্রাপ্তির মাধ্যমে তারা মহান বিজয়ের অধিকারী হবে, পুনরায় জেরুজালেমে উপসনালয় স্থাপন করবে। এ মেনোরার গুরুত্ব তাদের কাছে অত্যন্ত স্পর্শকাতর, যেমনটা মুসলমানদের কাবা ও খ্রিষ্টানদের নিকট ক্রুশ। বর্তমানে ইসরায়েল রাষ্ট্রের ভিত্তি এ মেনোরা। এমনকি তাদের পতাকায়ও এর চিহ্ন দৃশ্যমান। তারা উপসনালয় পুননির্মাণের আশায় এখনো প্রতীক্ষমাণ, আর তাদের উদ্দীপনার পেছনে মূল কাজ করছে মেনোরা। এটাই তাদের ক্রোধ উস্কে দিচ্ছে, আবরদের প্রতি বিদ্বেষ তৈরি করছে। লেখক এ উপন্যাসের মাধ্যমে তাদের এ বিশ্বাসের ভিত্তিকে একেবারে উড়িয়ে দিয়েছেন, যে কারণে ইজরায়েলে এ বইয়ের নিষিদ্ধকরণ। এ উপন্যাস পড়তে গেলে পাঠক কখনো দুর্বোধ্য দৃশ্যপট দেখবেন। কখনো চরিত্র ও ঘটনাপ্রবাহের মাঝে মিল খুঁজতে গিয়ে ভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবেন। লেখক তার নৈর্ব্যক্তিক উপস্থাপনায় কখনো ইউরোপের বরফ আচ্ছাদিত পাহাড়ে, কখনো জেরুজালেমের প্রাচীন বাড়িঘরে, কখনো ভ্যালি অব কিংয়ের রাজভবনে, আবার কখনো কায়রোর শোরগোলময় রাস্তায় পরিভ্রমণ করাবেন, যা চোখে দেখার মতো আপনার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠবে। এ উপন্যাস পড়ে আপনি মনে করতে পারেন যে, লেখক হয়তো ড্যান ব্রাউনের ধারা অবলম্বন করেছেন। তবে কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কারণ তিনি ঘটনাপ্রবাহ একাধিক চরিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করে ইতিহাসের গভীরে ডুব দিয়ে বাস্তবতাকে রহস্যাবৃত করে উপস্থাপন করেছেন। যার কারণে বিজ্ঞ পাঠক এ উপন্যাসকে দ্য ভিঞ্চি কোডের সাথে তুলনা করেছেন। এ উপন্যাসে আরব-ইসরায়েল সংঘর্ষ নতুনরূপে ধরা পড়ে, যা আমরা দূর থেকে বসে কল্পনাও করতে পারি না। লেখক নিজের মধ্যপন্থী অবস্থান থেকে উভয়ের স্বরূপ তুলে ধরেন। দোষের ভার থেকে কাউকে রেহাই দেননি, আবার একচেটিয়া কারো সমর্থন করে যাননি। বাস্তব হচ্ছে, আরব ও ইহুদিদের মাঝে এমন অনেক লোক আছে যারা শান্তিকামী, যারা চায় রক্তের হোলিখেলার এই বীভৎস আখ্যান শেষ হোক। ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ পল সসম্যান তার এ উপন্যাসকে আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে রচনা করেন, যাতে বাস্তবতার সাথে ইতিহাস, কল্পনা ও পৌরানিকতার সমন্বয় হয়। উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব এবং অতীতকালীন ইতিহাস তুলে ধরার পর বাস্তবিক ক্ষেত্রে তার প্রভাবসম্পন্ন দিকগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যাতে আমরা এসব চরিত্রকে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পারি। উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহে মিশর, ফিলিস্তিন, ইজরায়েল, জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের বিভিন্ন স্থানের আলোচনা এসেছে। আশা করি, পাঠকের সামনে অপেক্ষা করছে এক বিস্ময়কর ইতিহাস। যার পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে জেরুজালেমের উত্তেজনাপূর্ণ রহস্যপাঠ।