ইসলাম একটি বাস্তবধর্মী কালোত্তীর্ণ জীবন-ব্যবস্থার নাম। মানব জীবনের যতগুলো দিক রয়েছে, তার প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় রয়েছে ইসলামের অবাধ বিচরণ। অর্থ মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জন্মের আগ থেকেই অলক্ষ্যে মানুষ এটির সাথে জড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই সবার পিতামাতা প্রতিটি শিশুকে পরিচর্যা, চিকিৎসা, সেবা-শুশ্রƒষায় তাদেরকে অর্থের সাথে একাকার করে ফেলে। অপরদিকে মানুষের মৃত্যুর পরেও লাশ হয়ে যাওয়া মানুষটির সাথে অর্থনৈতিক ব্যাপারটি সম্পৃক্তই থাকে। দাফন-কাফন, কবরের স্থান প্রভৃতির জন্য প্রয়োজন দেখা দেয় অর্থের। তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, অর্থ সারাটি জীবন তো বটেই এমনকি জন্মের আগে ও পরেও মানুষের সাথে আঠার মত লেগে থাকে। যার সাথে মানব জীবনের এ অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, যাকে বাদ দিয়ে তাদের জীবন চাকা একবারেই অচল, একটি মুহূর্তও তা থেকে সম্পর্ক বিছিন্ন করার সুযোগ থাকে না, তাকে নিয়ে ইসলামের মত জীবনবিধানে কোনো দিকনির্দেশনা থাকবে না, তা কী করে হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ইসলাম মানবতার জন্য এমন অর্থনৈতিক নিয়মনীতি প্রণয়ন করেছে, যা শাশ্বত, কল্যাণকর ও কালজয়ী। যাকাত ও ‘উশর সেই ধারাবাহিকতায় মানবতার অর্থনৈতিক নিরাপত্তার এক বাস্তবধর্মী রাজপথ। একে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে, ইসলামের মূল অর্থনীতি, যার অসাধারণ কল্যাণকর ফল্গুধারায় মানবতা তার অর্থনৈতিক সকল সমস্যা সমাধানের রাস্তা নির্বিঘেœ খুঁজে পায়। ‘যাকাত ও ‘উশর’ মূলত ইসলামের একটি শাশ্বত অর্থনৈতিক বিধান। এ বিধান মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রণীত। এটিকে কার্যকর করা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলারই নির্দেশ। এ দুটি আদায় করা ফরজ। এ বিধান ইসলামের একটি স্তম্ভ। এর ফরযিয়াতকে অস্বীকারকারী ইসলামের মনীষীদের দৃষ্টিতে সর্বসম্মতিক্রমে কাফির বলেই সাব্যস্ত। সে জন্য মুসলিম জাহানের প্রথম খালীফা আবু বকর (রা) যাকাত প্রদানে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। উল্লেখ্য, যাকাতের বিধান স্বীকার করার পরেও আদায় না করা ফাসিকী ও কবীরা গুনাহ। এটি একটি ‘ইবাদাতও বটে। একজন ব্যক্তিকে মুসলিম বলে গণ্য হতে হলে, ইসলামের সকল ফরজ নির্দেশনাকে যেমন মেনে চলতে বাধ্য থাকতে হয়, যাকাত ও ‘উশর ব্যবস্থাও ঠিক তেমনি। সত্যিকারের সকল মুসলিম এ ব্যবস্থাকে মানতে ও অনুসরণ করতে বাধ্য। ইসলামের অন্যান্য ফরযিয়াত না মেনে যেমন পূর্ণ মুসলিম দাবি করা যায় না তেমনি যাকাত ও ‘উশর ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মুসলিম থাকা যায় না। এ ব্যবস্থা ইসলামী সমাজের অর্থনৈতিক প্রবাহ বজায় রাখার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। দারিদ্র্য হ্রাসে এর অবদান অনস্বীকার্য। অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় এর যুগান্তকারী ভূমিকার কোনো বিকল্প নেই। এটি ইসলামী অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যা দরিদ্র, নিগৃহীত, মুসাফির ও ঋণগ্রস্তদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার একটি প্রতিষ্ঠানও বটে। ইসলামের জিহাদের অর্থ যোগানের একটি খাতও এটি।
ইসলামের অপরিহার্য এ বিধানটি আমাদের মুসলিম সমাজে যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় আমাদের সমাজ অর্থনৈতিক সমস্যামুক্ত হতে পারছে না। সমাজের একশ্রেণির লোকেরা দারিদ্র্যের কষাঘাতে হচ্ছে নির্যাতিত, অপরদিকে অন্যশ্রেণি বিত্ত-বৈভবের সীমাহীন প্রাচুর্যতায় ভেসে যাচ্ছে। আসলে ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক কল্যাণ উপভোগকারী একটি কাক্সিক্ষত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে, ইসলামের যাকাত ব্যবস্থার প্রচলনই হচ্ছে এর একমাত্র পথ। সমাজতন্ত্রের ভরাডুবি, পুঁজিবাদের সীমাহীন ব্যর্থতা, মিশ্র অর্থনীতির দেওলিয়াপনাই এ কথার জাজ্জ্বল্য প্রমাণ যে, মানবতার অর্থনৈতিক মুক্তির একমাত্র পথই হচ্ছে, ইসলামের যাকাতভিত্তিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থার প্রবর্তন হলে, শুধু মুসলিম উম্মাহ নয় বরং সমগ্র বিশ্ব এর ফল্গুধারা থেকে আকণ্ঠ পান করে সার্থক ও সফল হতে পারবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
যদি আমরা ধরেও নেই যে, পাশ্চাত্যে বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, তারপরেও সপ্তম শতকে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে ইসলাম সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করে সমাজকল্যাণ নীতির ফলপ্রসূ প্রয়োগের মাধ্যমে যথার্থ কল্যাণ রাষ্ট্রের মডেল বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছে। এটি ঐ সময়ের কথা, যখন এ পৃথিবীতে সামাজিক নিরাপত্তা পরিকল্পনার নাম নিশানাও ছিল না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক জীবন বিধান যাকাত ব্যবস্থাই এ কৃতিত্বের একচ্ছত্র মালিক। যদি বৃটেনের রাণী এলিজাবেথের আমলের চড়ড়ৎ খধ-ি১৬০-কে সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের দৃষ্টান্ত হিসেবেও ধরা হয়, তাহলে তারও এক হাজার বছর পূবের্; আর যদি ১৮৮৩ সালে জার্মানিতে বিসমার্ক সম্মেলনে শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য গৃহীত অপপরংফবংরঃধষ ওহংঁৎধহপব অপঃ-কে উদাহরণ হিসেবে নেওয়া হয়, তাহলে তারও ১২৫০ বছর পূর্বে যাকাত নামক সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম রাষ্ট্রে সফলতার সাথে ইসলামই প্রবর্তন করেছে। একে বাস্তবায়ন করে এর সুফলও জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। সুতরাং যাকাত ব্যবস্থাপনাই হচ্ছে বিশ্ববাসীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা রক্ষার গ্যারান্টি, যা বলার অপেক্ষা রাখে না।
‘উশরও যাকাত ব্যবস্থাপনারই অংশবিশেষ। ফসলের যাকাতকেই ‘উশর বলা হয়। আর অন্যান্য সম্পদের যাকাত ‘যাকাত’ নামেই পরিচিতি লাভ করেছে। লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও হুকম-আহকামের ক্ষেত্রে এ দুয়ের মধ্যে তেমন কোনো ব্যবধান নেই। উভয়টিই আদায় করা ফরজ। তারপরেও সাধারণত অন্যান্য সম্পদের যাকাত আমাদের সমাজে যেমন পরিচিত, ‘উশর তেমনটি পরিচিত নয়। সে জন্য ‘উশর যাকাতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও একে সাধারণ জনগণের নিকট পরিচিত করার জন্য ‘উশর শব্দটিকে আমাদের এখানকার শিরোনামে উল্লেখ রাখা হয়েছে।