পৃথিবীতে নবি-রাসূল প্রেরণের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো—মানুষ যেন। তাঁদের আনুগত্য করে। —(আন-নিসা ৪:৬৪) সকল নবি-রাসূল -এর ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য হলেও, মুহাম্মাদ -এর ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি কার্যকর; কারণ অন্যান্য নবি-কে দেওয়া শারীআর অনেক কিছুই স্থান-কালে আবদ্ধ, পক্ষান্তরে মুহাম্মাদ -এর শারীআ স্থায়ী, সর্বত্র ও সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য। “বুলে দাও—লোকসকল! আমি তোমাদের সবার নিকট আল্লাহর বার্তাবাহক।” (আল-আরাফ ৭:১৫৮) “আমি তোমাকে সকল মানুষের জন্যই প্রেরণ করেছি।” -(সাবা ৩৪:২৮) যাঁরা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন মুক্তি চায়, তাঁদের জন্য আল্লাহর রাসূল স্ট-এর জীবনে রয়েছে। সর্বোত্তম আদর্শ।—(আল-আহ্যাব ৩৩:২১)। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল অঙ্গনে ইসলামকে একটি বিজয়ী জীবনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, নবি ই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। সেদিন থেকে আজকের সময় পর্যন্ত, বিজয়ী দ্বীন হিসেবে ইসলামের সুদীর্ঘ ইতিহাসে দু-বার বড় রকমের ছেদ পড়েছে; প্রথম ছেদটি পড়েছে খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, মঙ্গোলিয়ানদের হাতে মুসলিম সাম্রাজ্য তছনছ হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। বিজয়ী দ্বীন তখন সমাজ ও রাষ্ট্রের বৃহত্তর পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, ব্যক্তিজীবনের ক্ষুদ্র পরিসরে আশ্রয় নিয়ে কোনোরকমে টিকে থাকে। ঠিক সে সময়ই ইবনু তাইমিয়া, ইবনু কাইয়িম জাওযিয়্যা, ইবনু কাসীর ও যাহাবি (আল্লাহ তাঁদের সকলের উপর রহম করুন!) সহ আরও কিছু নিবেদিতপ্রাণ আল্লাহর বান্দার নিরলস পরিশ্রমের ফলে উম্মাহর মধ্যে আবার পুনর্জাগরণ দেখা দেয়। তারপর দ্বিতীয় আঘাতটি আসে খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতকে, ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের আকৃতিতে। এবারের আঘাতে মুসলিমদের ঘরবাড়ির ভৌতিক কাঠামো ততোটা ক্ষতিগ্রস্থ না হলেও, পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসেবে ইসলামের স্বকীয়তা একেবারে ম্লান হয়ে পড়ে। ইসলামের সর্বব্যাপী রূপ সমাজ-রাষ্ট্রের বলয় থেকে বিতাড়িত হয়ে, প্রথমে কিছুদিন ব্যক্তিজীবনের সংকীর্ণ রিমন্ডলে ঠাঁই নেয়। তারপর ধীরে ধীরে গণমানুষের ব্যক্তিজীবন থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে ইসলাম পরিণত হয় এক অদৃশ্য-অস্পৃশ্য দর্শনে। আর ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রের বৃহত্তর পরিধিতে সৃষ্ট শূন্যতায় তড়িঘড়ি করে জায়গা করে নেয় জাহিলিয়াত।
জাহিলিয়াতে ভরপুর একটি সমাজে ইসলামের প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে চাইলে, নবি -এর সীরাত বা জীবনচরিতই হলো সর্বোত্তম আদর্শ। নবি -কে যে জাহিলি সমাজের মোকাবেলা করতে হয়েছিল, বর্তমানকালে ইসলামকে তার স্বস্থানে ফিরিয়ে আনতে গেলে, আমাদেরকেও একই জাহিলিয়াতের মুখোমুখি হতে হবে। এ কারণে সীরাতের প্রয়োজনীয়তা সর্বজনীন হলেও, ইতিহাসের যে কোনও যুগের তুলনায় বর্তমান সময়ে এর প্রয়োজনীয়তা বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে।
নবি এ-এর ইন্তেকালের অব্যবহিত পর থেকেই তাঁর জীবনেতিহাস সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে। দেড় সহস্রাব্দি যাবৎ তাঁর জীবনের উপর রচিত হয়েছে শতসহস্র গ্রন্থ। প্রাচ্যবিদ ডি.এস. মারগুলিয়াথ (D. S. Margoliouth) লিখেছেন, The biographers of the Prophet Mohammed form a long series which it is impossible to end, but in which it would be honourable to find a place. ‘নবি মুহাম্মাদ-এর জীবনীকারদের একটি দীর্ঘ সারি রয়েছে, যা কখনও শেষ হওয়ার নয়; তবে সেখানে স্থান পাওয়াটাই সম্মানের ব্যাপার। নবি -এর জীবনেতিহাস জানার বড় দুটি মাধ্যম হলো সিয়ার (জীবনচরিত ও যুদ্ধবিগ্রহ) ও হাদীসের গ্রন্থাবলি৷ সিয়ার ও মাগাযী বিষয়ক সাহাবি, আলি—প্রভৃতি শব্দে ব্যবহার করা হয়েছে হ্রস্ব ই-কার; কারণ মূল ভাষায় এসবের প্রত্যেকটির শেষে 'ইয়া' বর্ণ থাকলেও, তা মাদ বা দীর্ঘস্বরের 'ইয়া সাকিন' নয়। তবে যেসব ক্ষেত্রে আরবি বিশুদ্ধ বানান ও প্রচলিত বাংলা বানানের মধ্যে ব্যবধান অনেক বেশি, সেখানে এমন এক বানান ব্যবহার করা হয়েছে—যা মূল স্বরের কাছাকাছি, আবার বাংলা ভাষাভাষী লোকদের নিকট সম্পূর্ণ অপরিচিত নয়; যেমন বিশুদ্ধ আরবি বানান ‘ওয়াহইয়ু’ এবং প্রচলিত বাংলা বানান ‘অহি’–এর কোনোটি ব্যবহার না করে, ‘ওহি’ ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, পাঠকের বোধগম্যতাকে সামনে রেখে আরবি শব্দাবলিকে প্রতিবর্ণীকরণের বিজ্ঞানসম্মত নীতিমালা প্রণয়ন করা হলে বর্তমান বানান-সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। গ্রন্থটির অনুবাদ নির্ভুল রাখার জন্য সাধ্য মোতাবেক চেষ্টা করেছি। তারপরও কোনও সুহৃদ বোদ্ধা পাঠকের চোখে যে কোনও ভুল ধরা পড়লে, আমাদেরকে অবহিত করার বিনীত অনুরোধ রইলো।
পরিশেষে, আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদের সামগ্রিক জীবন নবি -এর আলোকিত সীরাতের আলোকে ঢেলে সাজানোর তাওফীক দান করেন।