পৃথিবীতে এরকম কিছু মানুষ থাকেন, যারা সারা জীবন দেশ-বিদেশের ইতিহাস, কৃষ্টি-কালচার ও আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের টানে ছুটে বেড়াতে চায় দিক-বিদিক। ইবনে বতুতার সেই কালজয়ী সফরের মতো করে তারা ঘুরে ফেরেন এ দেশ ও দেশ। কেউ কেউ আবার পথকে বানিয়ে ফেলেন ঘর, যেন পথের টানে মুগ্ধ যাযাবর। এদের মধ্যে মুগ্ধ একদল বিশ্বপ্রেমী ঘরে ফিরে লিখতে শুরু করেন তাদের সফরের হালপুরসি। পৃথিবীর যেকোনো ভাষার সাহিত্যের ইতিহাসই সমৃদ্ধ থাকে সেই ভাষার ভ্রমণসাহিত্য দিয়ে—হোক সে ইংরেজি, আরবি, উরদু কিংবা বাংলা। প্রখ্যাত আলেম খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানির লেখা এই ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থটি উরদুভাষার সেরকমই এক বিখ্যাত ভ্রমণসাহিত্য।
একজন আলেমের চোখে দুনিয়া দেখা ও তার দুনিয়াতে ঘুরে ফেরার যে অনুভূতি, সেটা একজন মুসলিমের জন্য আসলে চমকপ্রদ কিছু। কেননা, তিনি পৃথিবীর তাবৎ সৌন্দর্য ঈমানের জানলা দিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। পথে ঘুরে সঞ্চিত সব অভিজ্ঞতার ডালি নিয়ে যে বইটি পাঠকের সামনে হাজির করেছেন—তাতে প্রথমেই রয়েছে তার হৃদয়ের আধ্যাত্মিক সফর; অর্থাৎ পবিত্র হজের সফর। এ সফর একজন মুমিনের জন্য অনেক বড় পাওয়া।
মক্কা-মদিনার অলিগলিতে গিয়ে তার হৃদয়ের যে বিহ্বল অবস্থা এবং হৃদয়ের যে আবেগরুদ্ধ বর্ণনাভঙ্গি, তা কেবল ওই পাঠকের হৃদয়কেই গভীরভাবে স্পর্শ করবে, যার রয়েছে রাসুলের প্রিয়তম শহর-দুটির প্রতি গভীরতর টান। কখনো সবুজ গম্বুজ দেখে তার হৃদয়ে উছলে ওঠে মহব্বতের ঢেউ, কখনো মনে পড়ে যায় বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ, ভারত-উপমহাদেশের দাঙ্গা ও খুনরক্তের হোলি খেলার কথা। নিজের মাতৃভূমির সঞ্চিত সমস্ত ব্যথাকে কাব্যে রূপান্তরিত করে রওজায়ে আতহারের সামনে বসে পরম শ্রদ্ধায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিবেদন করেন এই মরমিয়া শোক।
এরপর রয়েছে লেখকের পাকিস্তান সফর। ৪৭-এর দেশভাগের পর একজন ভারতীয় আলেমের পাকিস্তান দেখার অনুভূতি, সেখানকার ইউনিভার্সিটি ও মাদরাসাগুলো পরিদর্শন, বড় কজন বুযুর্গের সাথে সাক্ষাৎ—এরকম অনেক কিছু নিয়ে পাকিস্তানের স্মৃতিগুলো লিখেছেন।
অতঃপর ইরান ও কাতার ভ্রমণের কথা লিখেছেন। সে দুটি দেশে অবশ্য অল্প কিছু দিনই ছিলেন। ইরানে ইমাম খোমিনির মাজার ও বাড়ি পরিদর্শন করতে গিয়ে তার যেসব অনুভূতি, তাও লিখেছেন ইতিহাসের সারসংক্ষেপসহ; পাশাপাশি যুক্ত করেছেন ইরানের কিছু ইতিহাস ও ধর্মীয় সংস্কারের নানা দিক।
তারপর রয়েছে মরিশাস, দক্ষিণ আফ্রিকা, ও ভুস্বর্গ কাশ্মির ভ্রমণ। সেখানকার স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে তিনি প্রথমেই কাশ্মিরের ইতিহাস-বৃত্তান্ত তুলে ধরেন। তারপর কাশ্মিরের সৌন্দর্যময় জায়গাগুলোতে ঘোরা, সেখানকার মাদরাসা ও ইউনিভার্সিটি দেখার অনুভূতিগুলো তুলে ধরেন। ভারতীয় একজন আলেমের চোখে তাদেরই পরাধীন করে রাখা এক ভূস্বর্গকে দেখা, আবার নিজের হাতেই সে ইতিহাস ও সেখানকার দিনলিপি লেখা, একইসাথে মিশ্র আবেগের কাজ। লেখক এই কঠিন কাজটি অত্যন্ত যত্নের সাথে দায়বদ্ধতা নিয়েই পাঠকের সামনে হাজির করেছেন।
খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানির এই সফরনামা ভ্রমণসাহিত্যের এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। তিনি বিপুল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ পড়াশোনার অধিকারী দূরদর্শী একজন আলেম। তাই তার সফরমানাটি হয়ে উঠেছে দেশ-বিদেশের ইতিহাস পাঠেরও এক সুন্দর ও পরিশুদ্ধ চিত্রকল্প। মেধাবী অনুবাদক মাওলানা ইবরাহীম খলীলের ঝরঝরে বাংলা গদ্যে বইটি হয়ে উঠেছে বাংলাভাষারও ভ্রমণ-অনুবাদসাহিত্যে এক নতুন পালক।
একজন আলেমের দূরদৃষ্টির চোখ দিয়ে দেখা এই পৃথিবী ভ্রমণের বইটি পাঠকের আদর পাক। ভ্রমণপ্রেমীদের নিত্যপাঠের অংশ হোক, এই কামনা রাখি।