আমরা এমন একটা সময়ে বেঁচে আছি যখন জীবনকে মাপা হয় বস্তুর মানদণ্ডে। পরিচয় মাপা হয় উপার্জন দিয়ে। জীবনের সাফল্য হিসেব হয় পণ্য, ভোগ, সম্পদ আর সস্তা সুখের প্যারামিটারে। শিক্ষার উদ্দেশ্য ডিগ্রি পাওয়া, কাজের উদ্দেশ্য ভোগ করা। কী করো—মানে তুমি কত কামাই করো। কেমন চলছে—মানে তোমার স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং এখন কেমন। নৈতিকতার সবচেয়ে বড় মাপকাঠি হলো—‘মানুষ কী বলবে’, ‘সমাজের আর দশজন কী করছে’।
ছোটবেলা থেকে এভাবেই আমরা জীবনকে দেখতে শিখি, মাপতে শিখি, স্বপ্ন দেখি। এভাবেই আমরা সাফল্য খুঁজি। চাকার ভেতরে আটকে পড়া ইঁদুরের মতো ক্রমাগত ছুটে চলি। কিন্তু এই ছোটা আমাদেরকে গন্তব্যের কাছে নিয়ে যায় না। প্রতিটি দিন শুরু করি ঠিক যেন আগের জায়গা থেকে।
চক্র চলতে থাকে।
চারপাশে নিরন্তর গতিশীলতা, কিন্তু আমাদের হাতে সময় নেই। নির্বাসিত, পরাজিত, বিস্মৃত, পরিত্যক্ত হবার আশঙ্কা আমাদের থামতে দেয় না। যেন কোনো অসুস্থ প্রতিযোগিতা, কোনো মহাজাগতিক যিরো-সাম গেইমে আটকে গেছি আমরা। স্বাধীনতার মোড়কে কিনেছি দাসত্ব।
মানুষ ছুটতে শুরু করে সকালে। তারপর অবসন্ন চোখে যান্ত্রিক জঙ্গল পেরিয়ে ফিরে আসে সূর্য ডোবার সময়, দলবেঁধে। ধীর, অনুগত পদক্ষেপে গিয়ে ঢোকে অতিকায় অট্টালিকার পরস্পরবিচ্ছিন খোপে। ভাঙতে থাকা সমাজ, পরিবার আর মানুষের কথা ভুলে, পচনের গন্ধ বুকে নিয়ে সন্ধ্যা-রাতগুলো কাটিয়ে দেয় নিজস্ব নেশায়। কেউ গা ভাসায় রাতের জীবনের আদিম উল্লাসে, কেউ স্থির চোখে চেয়ে থাকে বোকা বাক্সের দিকে।
চক্র চলতে থাকে। বিরাজ করে এক অসুস্থ, অস্থির স্থিতিশীলতা।
অসুস্থ চক্রের মধ্যে আটকাপড়া এই আমাদের সময় হয় না জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য আর সফলতার অর্থ নিয়ে ভাবার। সুযোগ হয় না মহান আল্লাহ্কে স্মরণ করে তাঁর মুখোমুখি হবার মুহূর্তের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার। ঈমান জীর্ণ হতে থাকে, কিন্তু ছকবাঁধা, অভ্যস্ততার ধর্মপালনের বাইরে আর কিছু ভাবার ফুরসত মেলে না।
এভাবে সময় ফুরিয়ে আসে কিন্তু ছোটা বন্ধ হয় না। মূল গন্তব্যকে ভুলিয়ে দিয়ে এই অদ্ভূত জীবন মুসাফিরকে মশগুল করে রাখে অর্থহীন খুঁটিনাটিতে।
শুধু লেখা দিয়ে এই চক্রের ঘোর কাটানো সহজ না, হয়তো সম্ভবও না। কিন্তু এ বইয়ের লেখাগুলো আর কিছু না হোক, একবার হলেও আপনাকে দুনিয়ার ওপারের জীবনটাকে নিয়ে ভাবাবে। আপনার রবকে নিয়ে ভাবাবে। একটু মনোযোগ দিলে হয়তো নতুন এক জীবনের স্বপ্ন দেখতেও শেখাবে। ভাবাবে চক্র ভাঙার কথা। আমাকে ভাবিয়েছে। লেখাগুলো নিয়ে আরও অনেক কিছু বলা যায়, কিন্তু বইটা পড়ার কারণ হিসেবে সম্ভবত এটুকুই যথেষ্ট।